UNICEF Report: বাংলাদেশের শিশু দারিদ্র্যের হার অ্যালার্মিং লেভেলে

ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও, UNICEF-এর সর্বশেষ জাতীয় মাল্টি-ডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স (MPI) রিপোর্টে উঠে এসেছে এক অপ্রিয় বাস্তবতা—দেশের শিশু সমাজের একটি বড় অংশ এখনও দারিদ্র্যের কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও জীবনযাত্রার মান এই তিনটি মূল সূচকের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই রিপোর্টে শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও সুযোগের ঘাটতির একটি উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে।

UNICEF MPI রিপোর্ট কী বলে?

MPI বা মাল্টি-ডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স হল এমন একটি দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি, যা কেবল আয়ের ভিত্তিতে নয়, বরং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ঘাটতিগুলো একসাথে বিবেচনা করে। UNICEF-এর এই রিপোর্টে তিনটি প্রধান সূচক ধরা হয়েছে—

1. শিক্ষা: স্কুলে ভর্তি হার, উপস্থিতি, শিক্ষা মান

2. স্বাস্থ্য: শিশুমৃত্যুর হার, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি

3. জীবনযাত্রার মান: বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, নিরাপদ আবাসন

রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৪০% শিশু কোনো না কোনোভাবে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এর মধ্যে গ্রামীণ অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার শহরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

শিক্ষা খাতে শিশুদের বাস্তব অবস্থা

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হার তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও, স্কুলে উপস্থিতি ও মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের বড় অংশ পিছিয়ে। UNICEF রিপোর্টে দেখা গেছে—

প্রায় ২০% শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারে না।

দরিদ্র পরিবারগুলোতে শিশুরা প্রায়ই পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়।

গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে স্কুলে যাতায়াতের সুযোগ সীমিত, বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকায়।

এভাবে শিক্ষা খাতে ঘাটতি শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দারিদ্র্যের চক্রও অব্যাহত রাখছে।

স্বাস্থ্য খাতে উদ্বেগজনক চিত্র

রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিশু স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি হলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য হলো—

৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার এখনও দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে বেশি।

প্রায় ২৮% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

দরিদ্র পরিবারের শিশুরা প্রায়ই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অভাব ও ডাক্তার সংকট শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বড় বাধা।

জীবনযাত্রার মান ও মৌলিক সুযোগের ঘাটতি

MPI সূচকের আরেকটি বড় অংশ জীবনযাত্রার মান। UNICEF রিপোর্টে বলা হয়েছে—

প্রায় ৩৫% পরিবার বিশুদ্ধ পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পায় না।

৪০% শিশু নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

শহরের বস্তি ও গ্রামীণ এলাকার অনেক পরিবার এখনো বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা পায় না।

এই মৌলিক সুবিধাগুলোর অভাব সরাসরি শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে।

গ্রামীণ ও শহুরে বৈষম্য

একটি বড় চিত্র হলো গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের শিশু দারিদ্র্যের পার্থক্য। UNICEF-এর তথ্য অনুযায়ী—

গ্রামে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শহরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, ও শিক্ষা সুবিধার ঘাটতি গ্রামীণ শিশুদের পিছিয়ে রাখছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রামীণ শিশুদের জীবন আরও অনিশ্চিত।

দারিদ্র্যের কারণ

রিপোর্টে শিশু দারিদ্র্যের কয়েকটি মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—

1. অর্থনৈতিক বৈষম্য

2. মানসম্মত শিক্ষার অভাব

3. স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার

4. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

5. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা

সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ

UNICEF এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু দারিদ্র্য মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো—

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রান্তিক এলাকায় বিনামূল্যে শিক্ষাসুবিধা নিশ্চিত করা।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ।

বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা সর্বত্র নিশ্চিত করা।

দরিদ্র পরিবারের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি (যেমন—শর্তসাপেক্ষ নগদ সহায়তা) সম্প্রসারণ।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শিশু-বান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন।

উপসংহার

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা চলমান, কিন্তু শিশুদের জন্য বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের এই সংকট এক বড় হুমকি। UNICEF MPI রিপোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতের উন্নয়ন টেকসই হবে না।দরকার সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ—যাতে কোনো শিশুই দারিদ্র্যের কারণে তার স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে।

Share:

WhatsApp
Telegram
Facebook
Twitter
LinkedIn