বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্টিং: UNESCO কর্তৃক ‘Intangible Cultural Heritage’ হিসেবে স্বীকৃতি

বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে চলতে চলতে রঙের উজ্জ্বলতা, শিল্পের ঝলক এবং জীবন্ত কল্পনার জগৎ চোখে পড়লে বোঝা যায় — এটি রিকশা পেইন্টিং। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা বরিশালের পথঘাট রঙিন করে রেখেছে এই শিল্প। সম্প্রতি ইউনেস্কো (UNESCO) বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্টিংকে ‘Intangible Cultural Heritage’ বা অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এটি শুধু একটি শিল্পধারা নয়, বরং বাংলাদেশের নগরজীবনের এক অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়, যা একদিকে মানুষের রুচি, আনন্দ ও সৃজনশীলতার প্রতীক, অন্যদিকে বিশ্ববাসীর কাছে দেশের নান্দনিক সৌন্দর্যের দূত।

রিকশা পেইন্টিংয়ের ইতিহাস ও শিকড়

রিকশা প্রথম বাংলাদেশে আসে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। তখন শুধু বাহন হিসেবে রিকশা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রিকশা মালিকরা চালকদের আকর্ষণ এবং যাত্রীদের মন ভোলানোর জন্য রিকশার পিছনের প্যানেল ও বডি রঙিনভাবে সাজাতে শুরু করেন।প্রথমদিকে এতে ছিলো ফুল, পাখি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গ্রামীণ জীবনের ছবি। পরে সিনেমার পোস্টার, জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর মুখ, রাজনৈতিক বার্তা, এমনকি আধুনিক কার্টুন চরিত্রও রিকশা পেইন্টিংয়ে জায়গা করে নেয়।

এই শিল্পটি মূলত লোকশিল্প এবং এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং কর্মশালার ভেতরে শেখা ও চর্চার মাধ্যমে।

UNESCO স্বীকৃতির তাৎপর্য

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া মানে শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি বৃদ্ধি নয়, বরং এটি সংরক্ষণের জন্য একটি বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা তৈরি করা।‘Intangible Cultural Heritage’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে:

সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সংরক্ষণে অগ্রাধিকার

শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি

বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ

পর্যটন খাতে প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা

রিকশা পেইন্টিংয়ের বর্তমান অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ

যদিও এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য গর্বের, তবুও বাস্তবতা হলো—রিকশা পেইন্টিং শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কিছু বড় কারণ হলো:

1. কম পারিশ্রমিক – প্রতিটি ডিজাইনের জন্য শিল্পীরা খুব অল্প অর্থ পান।

2. নাম-পরিচয়ের অভাব – অনেকেই জানেন না কে এই শিল্পী, তাদের নাম রিকশায় লেখা থাকে না।

3. মেশিন প্রিন্টের আগ্রাসন – এখন রিকশার বডিতে প্রিন্টেড স্টিকার লাগানো হয়, যা সস্তা এবং দ্রুত।

4. নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ – কম আয়ের কারণে অনেক তরুণ এই পেশায় আসতে চায় না।

সংরক্ষণ ও পুনর্জাগরণের উদ্যোগ প্রয়োজন

যদি এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

সরকারি প্রণোদনা: শিল্পীদের জন্য অনুদান, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যসুবিধা।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: আর্ট কলেজ বা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রিকশা পেইন্টিংয়ের কোর্স চালু করা।

ট্যুরিজমে সংযোজন: বিদেশি পর্যটকদের জন্য রিকশা পেইন্টিং কর্মশালা ও প্রদর্শনী আয়োজন।

ডিজিটাল প্রচারণা: সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পীদের কাজ তুলে ধরা, অনলাইন প্রদর্শনী আয়োজন।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহক

রিকশা পেইন্টিং শুধু একটি সৃজনশীল নকশা নয়; এটি বাংলাদেশের শহুরে লোকসংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের ইতিহাস, আবেগ ও জীবনধারাকে রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এই শিল্পকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে বরং নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি সেই দায়িত্বকে আরও জোরালো করেছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে এক ধাপ উঁচুতে তুলেছে।

Share:

WhatsApp
Telegram
Facebook
Twitter
LinkedIn