প্রস্তাবনা
১৫ই আগস্ট ভারতের জন্য শুধু একটি তারিখ নয়, বরং এটি একটি গৌরবময় মুহূর্ত—যেদিন কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেয়েছিল। ১৯৪৭ সালের এই দিনে ভারত দীর্ঘ দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায়। এই স্বাধীনতা অর্জন ছিল অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী, শহীদ, এবং সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও সংগ্রামের ফল। এই নিবন্ধে আমরা ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াই, দেশভাগের কষ্ট, এবং আজকের প্রজন্মের জন্য এর গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. ভারতের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১.১ ব্রিটিশ শাসনের সূচনা
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ দিয়ে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে ভারতের প্রায় পুরো ভূখণ্ড ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসে।
১.২ শোষণ ও অত্যাচার
ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, উচ্চ কর, স্থানীয় শিল্প ধ্বংস, এবং বিভাজন নীতি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল করে তোলে।
২. স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা

২.১ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রথম বৃহৎ আন্দোলন। যদিও এটি পরাজিত হয়েছিল, তবুও এটি ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করে।
২.২ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
১৮৮৫ সালে গঠিত কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে সংস্কারের দাবিতে এগোলেও পরে এটি পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়।
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়
৩.১ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১)
ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বয়কট, স্বদেশি আন্দোলন ও গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
৩.২ অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-২২)
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
৩.৩ সল্ট মার্চ (১৯৩০)
লবণ আইন ভঙ্গ করে গান্ধীজীর দান্ডি অভিযান ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ।
৩.৪ ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে “করো বা মরো” স্লোগান দিয়ে ভারতীয়দের একতাবদ্ধ করা হয়।
৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতারা
মহাত্মা গান্ধী – অহিংস ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পথিকৃৎ।
জওহরলাল নেহরু – স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
সুভাষচন্দ্র বসু – আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা।
ভগত সিং, রাজগুরু, সুখদেব – শহীদ ত্রয়ী, যাদের ত্যাগ আজও প্রেরণা।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল – ঐক্যের লৌহপুরুষ।
৫. স্বাধীনতার মুহূর্ত: ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭
৫.১ মধ্যরাতের ঘণ্টাধ্বনি
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে জওহরলাল নেহরু “Tryst with Destiny” ভাষণ দেন। এই ভাষণের মাধ্যমে ভারত স্বাধীনতার নতুন যুগে প্রবেশ করে।
৫.২ দেশভাগের বেদনা
স্বাধীনতার সাথে সাথে ভারত ও পাকিস্তান বিভাজিত হয়। এই বিভাজন ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম শরণার্থী সংকট—প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়।
৬. স্বাধীনতার পর ভারতের যাত্রা
৬.১ সংবিধান প্রণয়ন
২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ভারত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
৬.২ উন্নয়নের পথচলা
স্বাধীনতার পর ভারত বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প, ও প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, যদিও দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং দুর্নীতির মতো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
৭. আজকের দিনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
৭.১ লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন
প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দেশের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
৭.২ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি
স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্যারেড, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং দেশাত্মবোধক গান পরিবেশিত হয়।
৭.৩ প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া
আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন আরও বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে।
৮. স্বাধীনতার তাৎপর্য
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা
মানবাধিকার রক্ষা
সমতা ও ন্যায়বিচার
জাতীয় ঐক্য ও গর্ব
৯. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বার্তা
স্বাধীনতা কেবল একটি অর্জন নয়—এটি একটি দায়িত্ব। আজকের প্রজন্মের কর্তব্য হলো দেশের ঐক্য বজায় রাখা, উন্নয়নে অবদান রাখা, এবং স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা।
উপসংহার
১৫ই আগস্ট ভারতের আত্মমর্যাদা, সাহস, এবং ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার এই গল্প আমাদের শেখায়—ত্যাগ ছাড়া কোনও বড় অর্জন সম্ভব নয়। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।