বাংলাদেশে সবুজ ভবন: BEEER রেটিং ও টেকসই নির্মাণের নতুন যুগ

বাংলাদেশ দ্রুত নগরায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আধুনিক অবকাঠামোর চাহিদা বাড়ার ফলে ভবন নির্মাণ খাতে জ্বালানি ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সবুজ ভবন বাংলাদেশ-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও টেকসই নির্মাণকে উৎসাহিত করতে ২০২৪ সালের মার্চে সরকার অনুমোদন দিয়েছে একটি নতুন মানদণ্ড—BEEER (Building Energy Efficiency and Environment Rating)।

‘BEEER’ রেটিং কী?

BEEER রেটিং হলো বাংলাদেশের নিজস্ব এক মূল্যায়ন ব্যবস্থা, যা ভবনের জ্বালানি দক্ষতা, পরিবেশগত প্রভাব এবং টেকসই নকশা মূল্যায়ন করে। এই সিস্টেমটি তৈরি করেছে Housing and Building Research Institute (HBRI) এবং Sustainable and Renewable Energy Development Authority (SREDA)।

BEEER-এর মূল উদ্দেশ্য:

ভবন নির্মাণে জ্বালানি দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার

নবায়নযোগ্য শক্তির অন্তর্ভুক্তি

পরিবেশ-বান্ধব উপকরণ ব্যবহার

পানির অপচয় রোধ ও পুনঃব্যবহার

অভ্যন্তরীণ বায়ু মান উন্নয়ন

বাংলাদেশে সবুজ ভবনের ইতিহাস

বাংলাদেশে প্রথম সবুজ ভবন নির্মাণ শুরু হয় ২০১১ সালে। তখন ‘GreenARCH’ নামে একটি ধারণা আনা হয়, যা সবুজ স্থাপত্যের নীতি অনুসরণ করে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়, বাণিজ্যিক ভবন এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে সবুজ নকশা ব্যবহারের প্রচলন বাড়ে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যেমন LEED বা EDGE অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল ও জটিল ছিল। তাই দেশীয় জলবায়ু, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে BEEER তৈরি করা হয়, যাতে স্থানীয়ভাবে মানানসই একটি ‘সবুজ রেটিং সিস্টেম’ পাওয়া যায়।

BEEER’ রেটিংয়ের মূল ক্যাটেগরি

BEEER সিস্টেম একটি ভবনকে নিম্নোক্ত মানদণ্ডে মূল্যায়ন করে—

1. এনার্জি এফিশিয়েন্সি (Energy Efficiency) – বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহারের দক্ষতা।

2. ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট (Water Management) – বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুনঃব্যবহার, এবং অপচয় রোধ।

3. ম্যাটেরিয়াল সিলেকশন (Material Selection) – পরিবেশ-বান্ধব ও টেকসই উপকরণ ব্যবহার।

4. ইনডোর এনভায়রনমেন্ট (Indoor Environment) – প্রাকৃতিক আলো, বায়ু চলাচল, এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক কমানো।

5. সাইট প্ল্যানিং ও ল্যান্ডস্কেপিং – জমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও সবুজায়ন।

গ্রেডিং সিস্টেম

BEEER রেটিং-এর মাধ্যমে ভবনকে সাধারণত ৪ ধাপের মধ্যে গ্রেড দেওয়া হয়:

প্লাটিনাম – সর্বোচ্চ টেকসই মান

গোল্ড

সিলভার

ব্রোঞ্জ – ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণকারী

এই ধাপগুলো ভবনের নকশা, নির্মাণ ও পরিচালনার সময়কার সেরা অনুশীলনের উপর নির্ভর করে।

কেন টেকসই নির্মাণ জরুরি?

বাংলাদেশের নগর এলাকায় দ্রুত ভবন বৃদ্ধি জ্বালানি ব্যবহার, পানির চাহিদা, এবং বর্জ্য উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সাধারণ কংক্রিট ভবন নির্মাণে বিশাল পরিমাণ CO₂ নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

টেকসই নির্মাণ বাংলাদেশে শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও।

বিদ্যুৎ বিল কমানো

পানির ব্যবহার হ্রাস

রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমানো

বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন

আন্তর্জাতিক তুলনায় ‘BEEER’-এর বিশেষত্ব

যেখানে LEED বা BREEAM সিস্টেম আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে BEEER বাংলাদেশের জলবায়ু, উপকরণ, এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছে।

খরচ কম: আন্তর্জাতিক রেটিং সিস্টেমের তুলনায় সার্টিফিকেশন ফি ও পরামর্শ খরচ কম।

স্থানীয় উপকরণ: বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় সম্পদ ব্যবহার।

সরকারি অনুমোদন: ২০২৪ সালে সরকারিভাবে অনুমোদন পাওয়ায় এটি এখন নীতিগত সহায়তা পাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

HBRI ও SREDA ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সব বড় ভবন নির্মাণে BEEER রেটিং বাধ্যতামূলক করা হবে। এছাড়া, সবুজ ভবন নির্মাণে ট্যাক্স ছাড়, ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানো, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপনে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

চ্যালেঞ্জ

যদিও BEEER রেটিং ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—

প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব: ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি ও নির্মাণশ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

প্রাথমিক বিনিয়োগ খরচ বেশি: যদিও দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী, কিন্তু শুরুতে খরচ তুলনামূলক বেশি।

জনসচেতনতার ঘাটতি: অনেক নির্মাতা ও বাসিন্দা এখনও সবুজ ভবনের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত নয়।

উপসংহার

বাংলাদেশে সবুজ ভবনBEEER রেটিং সিস্টেম ভবিষ্যতের নগর উন্নয়নে একটি বড় মাইলফলক হতে পারে। সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করলে টেকসই নির্মাণ বাংলাদেশে শুধু পরিবেশের জন্য নয়, অর্থনীতির জন্যও সুফল বয়ে আনবে।

সবুজ ভবন নির্মাণ শুধু একটি ট্রেন্ড নয়—এটি একটি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, জ্বালানি সাশ্রয়, এবং সুস্থ জীবনযাপনের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি নগরে সবুজ ভবনের প্রসার জরুরি।

Share:

WhatsApp
Telegram
Facebook
Twitter
LinkedIn