বাংলাদেশ বায়ু দূষণ, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাংলাদেশ, Clean Air Bangladesh
ভূমিকা
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ, কিন্তু এই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে এক ভয়াবহ সমস্যা—বায়ু দূষণ।পরিবেশ অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এখন শীর্ষ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। প্রতিবছর প্রায় ২,৩৬,০০০ মানুষ সময়ের আগে মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কারণে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলো প্রায় সারা বছরই বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর বা অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় থাকে।
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণ
বায়ু দূষণের পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে, যা প্রধানত মানুষের কার্যকলাপের ফল:
১. শিল্প ও কারখানা
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা ইটভাটা, গার্মেন্টস কারখানা, কেমিক্যাল প্রসেসিং ইউনিট প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া ও ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত করে।
বিশেষ করে ইটভাটায় কাঠ, কয়লা ও নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ব্ল্যাক কার্বন ছড়ায়।
২. যানবাহন ও পরিবহন ব্যবস্থা
পুরনো ও রক্ষণাবেক্ষণহীন যানবাহন থেকে প্রচুর পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০ কণিকা নির্গত হয়।
গণপরিবহনে নিম্নমানের ডিজেল ও পেট্রোল ব্যবহারের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।
৩. নির্মাণকাজ ও ধুলা
সারা বছরব্যাপী চলমান নির্মাণকাজ থেকে ধুলা ও ক্ষুদ্র কণিকা বাতাসে মিশে বায়ুমান নষ্ট করে।
শহুরে এলাকায় খোলা জায়গায় মাটি ও বালুর স্তূপও ধুলা উৎপাদনের অন্যতম উৎস।
৪. কৃষি ও গ্রামীণ জ্বালানি ব্যবহার
গ্রামে এখনও রান্নার জন্য কাঠ, খড়, গাছের ডাল এবং গোবরের গুঁড়ি পোড়ানো হয়, যা ধোঁয়ার মাধ্যমে বায়ু দূষিত করে।
কৃষিজমিতে ফসল কাটার পর খড় পোড়ানোও বায়ুমান খারাপ করে।
জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি: কেন এটি এত ভয়াবহ
বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এখন শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়—এটি একটি বিশাল জনস্বাস্থ্য সংকট।
শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি: শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে।
হৃদরোগ: দূষিত বাতাসে দীর্ঘ সময় থাকলে হার্ট অ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।
ক্যান্সার: পিএম ২.৫-এর মতো সূক্ষ্ম কণিকা ফুসফুসে জমে গিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করে।
প্রিম্যাচিউর ডেথ: WHO-এর মতে, বায়ু দূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২.৩৬ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়।
বিশেষ করে শিশুদের ফুসফুস এখনও বিকাশমান থাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
বর্তমান পরিস্থিতি: সংখ্যা বলছে সবকিছু
২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গড় AQI (Air Quality Index) শীতকালে প্রায়শই ৩০০-এর বেশি থাকে, যা “Hazardous” ক্যাটাগরিতে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার তুলনায় বাংলাদেশে বাতাসে পিএম ২.৫ কণিকার পরিমাণ ৭-৮ গুণ বেশি।
WHO-এর গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্টে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় প্রায় শীর্ষে থাকে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
বায়ু দূষণ কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে:
১. Clean Air and Sustainable Environment (CASE) প্রজেক্ট
বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় চালু এই প্রকল্পে পুরনো যানবাহন অপসারণ, যানবাহনের এমিশন পরীক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২. Clean Air Bangladesh উদ্যোগ
সচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণা ও নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শহরের বায়ুমান উন্নয়নের জন্য কাজ করছে।
জনসাধারণকে AQI সম্পর্কে সচেতন করতে মোবাইল অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে।
৩. ইটভাটা সংস্কার
সরকার জিগজ্যাগ প্রযুক্তির ইটভাটা চালুর মাধ্যমে কয়লার ব্যবহার কমাতে কাজ করছে।
অনুমোদনবিহীন ইটভাটা বন্ধে অভিযান চলছে।
৪. গণপরিবহনে উন্নয়ন
সিএনজি ও ইলেকট্রিক বাস চালুর পরিকল্পনা।
পুরনো যানবাহন ধাপে ধাপে বাদ দেওয়ার নীতি গ্রহণ।
সমাধানের পথ
নীতি ও আইন বাস্তবায়ন
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিল্প ও নির্মাণ প্রকল্পে এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার
ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী প্রচার।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।
সচেতনতা বৃদ্ধি
স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ বিষয়ে শিক্ষা ও প্রচারণা চালাতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে মাস্ক ব্যবহার ও গাছ লাগানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা
ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড যানবাহন উৎসাহিত করা।
হাঁটা ও সাইকেল চলাচলের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা।
উপসংহার
বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এখন সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, একটি সুস্থ ও টেকসই জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।Clean Air Bangladesh-এর মতো উদ্যোগগুলোকে আরও শক্তিশালী করে পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।