Anas Al-Sharif: Gaza’s Brave Voice Killed While Reporting Truth | আল জাজিরা সাংবাদিক নিহত সংবাদ

ভূমিকা

২০২৫ সালের ১০ আগস্ট সকাল। গাজা সিটি তখনও ঘুম ভাঙতে পারেনি, কিন্তু আকাশে যুদ্ধবিমানের গর্জন আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল অবিরত। আল জাজিরা আরবী পরিষেবার অভিজ্ঞ ও সাহসী সাংবাদিক এনস আল-শরিফ ঠিক সেই সময়ে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছিলেন—গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণ চলছে। কয়েক মিনিট পরেই একটি ইসরায়েলি বিমান হামলা আল-শিফা হাসপাতালের কাছের সাংবাদিক তাঁবুতে আঘাত হানে। সেখানে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা অবস্থান করছিলেন। সেই আঘাতে এনস সহ সাতজন নিহত হন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই আল জাজিরার সাংবাদিক।

শৈশব ও শিক্ষা

১৯৯৬ সালে গাজা স্ট্রিপের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন এনস আল-শরিফ। শৈশব থেকেই তিনি যুদ্ধ ও সংঘাতের বাস্তবতা চোখে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে সাংবাদিকতার পথে টেনে আনে। গাজার স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কাজ শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর নির্ভীক প্রতিবেদনের জন্য তিনি পরিচিতি পান।

২০১৮ সালে তিনি “সেরা যুব সাংবাদিক” হিসেবে একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কার ছিল তাঁর পেশাগত যাত্রায় এক বড় স্বীকৃতি।

সাংবাদিকতা জীবন

এনস আল-শরিফ ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ থেকে শুরু করে একাধিক সংঘাতের সময় সরাসরি ফ্রন্টলাইনে রিপোর্ট করেছেন। তিনি মূলত উত্তর গাজা অঞ্চল থেকে আল জাজিরার হয়ে সংবাদ পাঠাতেন এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, ও মানবিক সংকটের ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতেন। তাঁর প্রতিবেদনে ছিল বাস্তবতার নির্ভুল উপস্থাপন—কোনো রাজনৈতিক চাপ বা ভয়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি।

তিনি নিজেও বহুবার বলেছেন—

> “আমি কখনও সত্যকে বিকৃত করি না। আমার কাজ হল যা ঘটছে, তা বিশ্বকে জানানো।”

মৃত্যুর আগে শেষ মুহূর্ত

১০ আগস্ট ভোরে গাজা সিটিতে তীব্র বোমাবর্ষণ শুরু হয়। এনস তখনও সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর X (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে শেষ পোস্টটি ছিল—“ননস্টপ বোমা বর্ষণ… দুই ঘণ্টা ধরে গাজা সিটিতে ইসরায়েলি আক্রমণ তীব্র হচ্ছে।”

এই পোস্টের কয়েক মিনিট পরেই আল-শিফা হাসপাতালের কাছের সাংবাদিক তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলা হয়। হামলার লক্ষ্য ছিল তাঁবুর ভেতরে অবস্থানরত মানুষরা—যেখানে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদকর্মীরা নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ছিলেন। সেই আঘাতে এনস আল-শরিফসহ সাতজন নিহত হন; আহত হন আরও অনেকে।

সহকর্মীদের মৃত্যু

এই হামলায় নিহত অন্য আল জাজিরা সাংবাদিকরা হলেন—

মুহাম্মদ কুইরাইকেহ

ইব্রাহীম জাহের

মুহাম্মদ নুফাল

মোয়ামেন আলিয়া

তাঁরা সকলে গাজা যুদ্ধের মানবিক চিত্র তুলে ধরতে দিন-রাত পরিশ্রম করছিলেন।

ইসরায়েলের অভিযোগ ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) দাবি করেছে—এনস আল-শরিফ ছিলেন “হামাসের একটি সেল নেতা” এবং সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিলেন। এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা প্রকাশ করেনি।

আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন, জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি, এবং মানবাধিকার গ্রুপ এই অভিযোগকে প্রমাণহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। আল জাজিরা এই হত্যাকাণ্ডকে আখ্যা দিয়েছে—

> “সাংবাদিকতাকে নীরব করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হামলা।”

বিশ্বের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও শোকের স্রোত বয়ে যায়।

কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) বলেছে—“গাজা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের জন্য।”

জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর গভীর শোক প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ও একাধিক আরব দেশ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে।

গাজায় সাংবাদিক হত্যার প্রেক্ষাপট

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-হামাস সংঘাতে এখন পর্যন্ত শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি। সাংবাদিকদের মতে, গাজায় সংবাদকর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট হচ্ছেন—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও যুদ্ধবিধির গুরুতর লঙ্ঘন।

এনস আল-শরিফের উত্তরাধিকার

এনস শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন গাজার মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর প্রতিবেদনে ছিল ধ্বংসস্তূপের ছবি, আহত শিশুর কান্না, খাদ্য ও চিকিৎসার সংকটে ভোগা পরিবারের বেদনা। তিনি বিশ্বাস করতেন—

> “সত্যকে বলা মানে হলো, অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।”

তাঁর সহকর্মী ও পরিবার বলছে—তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মিশন সম্পন্ন করেছিলেন।

উপসংহার

এনস আল-শরিফের মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির প্রাণহানি নয়, বরং সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর একটি গভীর আঘাত। যুদ্ধক্ষেত্রে সত্য বলার মানুষদের কণ্ঠস্বর রোধ করা হলে, বিশ্ব অন্ধকারে ঢেকে যাবে। গাজার রক্তাক্ত আকাশে এনসের নাম এখন প্রতীক—সাহস, সত্য আর আত্মত্যাগের।

Share:

WhatsApp
Telegram
Facebook
Twitter
LinkedIn